সীরাতে ইবনে কাসীর

আল্লাহর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী সম্পর্কে রচিত এক অনবদ্য ইতিহাসগ্রন্থ। সুপ্রাচীন এই ইতিহাসগ্রন্থ আমাদের সামনে মেলে ধরবে নবি জীবনের এক প্রাণবন্ত উপাখ্যান।

লেখকইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ
ভাষান্তরআহমাদ তামজিদ হাফিজাহুল্লাহ
বিষয়বস্তুসীরাহ, নবিজীর জীবনচরিত
সম্ভাব্য প্রকাশকালফেব্রুয়ারি, ২০২৫

দুনিয়া ডুবে আছে এক নিকষ কালো অন্ধকারে। চারদিকে মানুষের হাপিত্যেশ। অনিয়ম, অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলায় অতিষ্ঠ জনজীবন। ক্ষমতাবানেরা এখানে প্রভু আর দূর্বলেরা দাস।

মানুষে মানুষে হানাহানি, রেষারেষি চূড়ান্ত পর্যায়ে। সামান্য মতবিরোধে এক গোত্র অন্য গোত্রের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। মুহূর্তে বেজে উঠছে রণধ্বনি। অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। সদ্য জন্ম নেওয়া কন্যা শিশুর জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ তিমির রাত্রি। নিজের পিতা কিংবা ভাই অথবা গোত্র নেতারা তাকে জীবন্ত পুঁতে দিয়ে আসে বিরান মরুভূমি প্রান্তরে।

দ্বিগ্বিদিক শূন্য হয়ে মানুষেরা ছুটতে থাকে এখানে ওখানে। কেউ কেউ আকাশের দিকে তাকায় বারংবার। কেউ কেউ জানে—এহেন পরিস্থিতিতে একজন পয়গম্বর দুনিয়াতে আসেন। মুসা এসেছেন, ঈসা এসেছেন। তবে কি সেই সময়টা অত্যাসন্ন?

রবিউল আউয়াল মাসের এক পবিত্র মাহেন্দ্রক্ষণ। কুরাইশ নেতা আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আবদুল্লাহর ঘর আলো করে আসে একটুকরো আসমানি আলো। সেই আলোর বিচ্ছুরণ এতো প্রকট আর প্রবল ছিল যে, ধাত্রী শিফা উম্মু আবদুর রহমান বলেন, ‘জন্মের সাথে সাথে তাঁর শরীর থেকে একটি আলোর রেখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আলো এতোখানি উজ্জ্বল আর প্রকট ছিল যে—সেই আলোতে রোমের প্রাসাদগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল’।

ধাত্রী শিফা উম্মু আবদুর রহমান যে আলোর ঝলকানিতে রোম সাম্রাজ্যের প্রাসাদগুলো দেখতে পেয়েছিলেন, সেই আলো একদিন ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়াময়। সে আলো বদলে দেয় সভ্যতা আর ইতিহাসের গতিপথ। সে আলোতে দূরীভূত হয়ে জগতের সকল অন্ধকার। সে আলোর ধারক আর বাহক হলেন রাহমাতুল্লিলিল আলামীন মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহিমান্বিত জীবনকে ঘিরে যুগে যুগে অসংখ্য গ্রন্থ লেখা হয়েছে। অনেক নিবেদিতপ্রাণ মানুষ নিজেদের কলমে তুলে এনেছেন এই বরকতময় জীবনের উপাখ্যান।

জ্ঞানের জগতে ইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ এক বিস্ময়কর চরিত্র। একাধারে তিনি ছিলেন মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকিহ এবং যুগশ্রেষ্ঠ একজন ইতিহাসবিদ। কুরআনের ব্যাখ্যার জন্য তার লেখা ‘তাফসির ইবন কাসীর’কে শ্রেষ্ঠ একটা তাফসির বলে সকলে স্বীকার করেন। ইতিহাস বিষয়ে তার রচিত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ হলো ইসলামি ইতিহাসের এক যুগশ্রেষ্ঠ দলিল। এবং ইতিহাসের সেই আকরগ্রন্থের অনেকটাজুড়েই রয়েছে রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনোপাখ্যান।

‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ রচনার পর থেকে আজ অবধি আল্লাহর রাসূলের যত জীবনীগ্রন্থ রচিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে দলিল, ইতিহাসের ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ রূপ আর ঘটনা পরম্পরার জন্য ইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহর ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’র দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আজকের দিনেও আমরা রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যত সুবিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ দেখি, সেগুলোর অধিকাংশের ভিত্তিমূল গিয়ে ঠেকেছে ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ তে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মহান এই ইমামের কাজটাকে ঠিক এভাবেই কবুল করেছিলেন। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি!

‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ ইসলামের ইতিহাসের এক সুপরিসর গ্রন্থ। সৃষ্টির শুরু থেকে সৃষ্টির শেষ অবধি ঘটনাগুলোকে পরম্পরায় সাজিয়েছেন ইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ। বিশাল এক সময়ের ব্যাপ্তিকে ধারণ করে বলে এই গ্রন্থ ঠেকেছে এক সুবিশাল কলেবরে গিয়ে।

তবে, কেমন হতো যদি ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ থেকে শুধু আল্লাহর রাসূলের জীবনীটুকু আলাদা করে পড়া যেত? ঠিক সেভাবে যেভাবে বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ, আজ থেকে বহু বহু শতাব্দী আগে?

ঠিক এই কাজটিই করেছেন শাইখ মুহাম্মাদ আবু হুসাইন আবু যাহরা। সুবিশাল কালজয়ী ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ থেকে তিনি আলাদা করেছেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অংশটুকু। তবে, তিনি ভূমিকাতে বলেছেন—এই সংকলনে একটা শব্দ তিনি নিজ থেকে যুক্ত করেননি। ঠিক যেভাবে ইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ তার সুবিখ্যাত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ তে এনেছেন, প্রতিটা শব্দ, বাক্য এবং ঘটনা পরম্পরা তিনি সেভাবেই রেখেছেন। শুধু কিছু ঘটনাবলিতে শিরোনাম যুক্ত করেছেন পাঠকদের সুবিধার্থে।

যুগ যুগ ধরে যে গ্রন্থটি ইসলামি ইতিহাসবিদদের কাছে নির্ভুল, নির্ভরশীল বলে প্রশংসিত হয়ে এসেছে, সেই গ্রন্থ থেকে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনীকে আলাদাভাবে জানতে শাইখ মুহাম্মাদ আবু হুসাইন আবু যাহরার এই সংকলন এক ঐতিহাসিক ঘটনা হয়েই থাকবে, ইনশা আল্লাহ।

আল্লাহর দরবারে অশেষ শোকর যে, বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য এই কালজয়ী কাজটাকে সুকুন পাবলিশিং ‘সীরাতে ইবনে কাসীর’ নামে প্রকাশ করার সৌভাগ্য লাভ করছে, আলহামদুলিল্লাহ। এই সুবিন্যস্ত পূর্ণাঙ্গ নবিজীবনী একদিকে যেমন প্রাচীন আকরগ্রন্থ থেকে নবিজীবন পাঠ করার তৃষ্ণাকে নিবারণ করবে, অন্যদিকে পাঠকেরা নবিজীবনের এমন অনেক নতুন দিকের সাথে পরিচিত হবেন যা সচরাচর আধুনিক জীবনীগ্রন্থগুলোতে দূর্লভ।

আলহামদুলিল্লাহ, ঐতিহাসিক এই গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় প্রকাশের প্রাথমিক কাজ আমরা ইতোমধ্যেই সমাপ্ত করেছি। পরের ধাপগুলো অতিক্রম করে, অত্যন্ত যত্ন আর ভালোবাসার সহিত কাজটাকে আমরা পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আশা রাখছি, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহই একমাত্র তাউফিকদাতা।
.

সুকুন পাবলিশিং
শব্দে আঁকা স্বপ্ন..