তাফসির আত তাবারি

সুপ্রাচীন আর প্রসিদ্ধ তাফসির আত তাবারির সারনির্যাসে রচিত কুরআনের তাফসির গ্রন্থ।

মূলইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত তাবারি রাহিমাহুল্লাহ
সংক্ষেপণড. আকিল ইবনু সালিম হাফিজাহুল্লাহ
বিষয়বস্তুকুরআনের তাফসির
অন্যান্য-----------------------------------------

শুরুতেই সমস্ত প্রশংসা মহান রাব্বুল ‘আলামীনের জন্য। আমরা তাঁরই ইবাদাত করি এবং একমাত্র তিনিই আমাদের সাহায্যদাতা। অগণিত দরুদ আর সালাম প্রিয়নবি মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরে যিনি আমাদের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর পরিবার, সকল সঙ্গী-সাথী এবং প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের অগণন ভালোবাসা।

মানবজাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নাযিল করেছেন পবিত্র কুরআন। এটিই একমাত্র এবং সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ যা নির্দিষ্ট কোনো কওম, কোনো গোত্র অথবা জনপদবাসীর জন্য নাযিল না হয়ে গোটা বিশ্বজাহানের জন্য নাযিল হয়েছে। এই গ্রন্থকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা করেছেন বিশ্বজনীন।

কুরআন হলো নূর তথা আলো। অন্ধকারের অভয়ারণ্যে কুরআন এনে দেয় আলোকিত ভোর। সাড়ে চৌদ্দ’শ বছর আগের সেই জাহিলিয়াতের অন্ধকারে এই কুরআন এমন এক আলোময় পথের সন্ধান নিয়ে এসেছিলো যা মানুষকে পৌঁছে দেয় তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। পথহারাদের জন্য এই কুরআন হয়ে উঠেছে পথের দিশা। সত্যের জন্য তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে এটা আবির্ভূত হয়েছে সুমিষ্ট পানি হয়ে। তাবদাহে পুড়ে খাক হওয়া হৃদয়ের জন্য এটা যেন প্রশান্তির ঝর্ণাধারা।

কুরআন শুধু মানুষের হৃদয়েই আলো ছড়ায় না, পাল্টে দেয় সভ্যতার গতিপথও। পাপাচার আর অনাচারে আমগ্ন ডুবে থাকা একটা জাতিকে এই কুরআন এমন আমূল পরিবর্তন করে দেয় যে, তারা বদলে দেয় দুনিয়ার ইতিহাস। রচনা করে নতুন অধ্যায়, তৈরি করে নতুন উপাখ্যান।
নাযিলের পর মুহূর্ত থেকেই এই কুরআন নিয়ে শুরু হয়েছে ভাবনা-চিন্তার পশরা। আজও পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ—পৃথিবীর আনাচে কানাচে এই কুরআন নিয়ে চলছে গবেষণা। নিরন্তর চিন্তা আর নিঃসীম ভাবনা। কুরআনের চিন্তাগুলোর প্রসারিত রূপকে আমরা ‘তাফসির’ হিসেবে জানি এবং ইসলামে ‘তাফসির শাস্ত্র’ জ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

ইসলামের ইতিহাসে যতোগুলো তাফসির রচিত হয়েছে, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-তাবারি রাহিমাহুল্লাহ কর্তৃক রচিত তাফসির, যেটা ‘তাফসির আত-তাবারি’ নামে প্রসিদ্ধ, সেসবের মধ্যে প্রাচীনতম এবং বিশুদ্ধতার দিক থেকে অনন্য উচ্চতার অধিকারী। ইমাম সুয়ূতি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘ইমাম তাবারির তাফসির বিশুদ্ধতায় অনন্য এবং জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারণে এটির ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক’।

ইসলামের আরেক সিপাহসালার, জ্ঞানের মহীরুহ ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মানুষের হাতে মজুদ থাকা কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোর মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত তাবারি রচিত তাফসির অনন্য’। ইমাম ইবন খুযাইমাহ রাহিমাহুল্লাহ আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘তাফসির শাস্ত্রে মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত তাবারির চেয়ে অধিক পারদর্শী কাউকে পাওয়া যায় না’।

প্রসিদ্ধ আছে, ইমাম তাবারি রাহিমাহুল্লাহ এই তাফসিরকে ত্রিশ হাজার পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নিজের হায়াত এবং এটার পাঠকশ্রেণীর কথা ভেবে তিনি তাঁর কাজটাকে ত্রিশ হাজারের বদলে তিন হাজার পৃষ্ঠায় নামিয়ে আনেন। পরবর্তীতে সেই ‘তাফসির আত তাবারি’কে সামনে রেখে রচিত হয় আরো অসংখ্য তাফসির গ্রন্থ। ‘তাফসির আত তাবারি’ কুরআনের ব্যাখ্যাকারদের কাছে হয়ে উঠে প্রাথমিক উৎসস্থল।

তবে, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত তাবারি তাঁর তাফসির তিন হাজার পৃষ্ঠায় নামিয়ে আনার পরেও, সেটা এখনো দুনিয়ায় মজুদ থাকা সর্ববৃহৎ কলেবরের তাফসিরগুলোর একটা। সর্বপ্রথম সংস্করণে এই তাফসির সমাপ্ত হয় ত্রিশ খণ্ডে গিয়ে। আর, এই তাফসির এতো বিস্তৃত এবং সুপ্রসারিত যে, একাডেমিক এবং তাত্ত্বিক বোদ্ধাগণের জন্যই এই তাফসির সবিশেষ উপকারি। এর বিন্যাস শৈলী, বক্তব্য এবং বর্ণনার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য সাধারণ পাঠকেরা এই তাফসিরের নির্যাস বুঝে উঠতে সমর্থ হবেন কম।

কিন্তু, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত তাবারি রাহিমাহুল্লাহর জ্ঞানের সুধা থেকে ইলম-পিয়াসী সাধারণ পাঠকেরা বঞ্চিত হবেন কেনো? ইলম অণ্বেষণকারী সাধারণ মানুষদের কথা ভেবে আরবের প্রখ্যাত স্কলার ড. আকিল ইবনু সালিম হাফিজাহুল্লাহ পুরো তাফসির আত তাবারি থেকে এর মূল নির্যাসটুকু নিয়ে الخلاصة من تفسير الطبري নামে এটাকে সংক্ষিপ্ত একটা সংস্করণে মলাটবদ্ধ করেছেন।

যারা ইমাম তাবারি রাহিমাহুল্লাহর রচিত সুবিশাল তাফসির গ্রন্থটি অধ্যয়নের সময়, সুযোগ আর সক্ষমতা রাখেন না, তাদের জন্য ইমাম তাবারি রাহিমাহুল্লাহর চিন্তার নির্যাসটুকু সাধারণ উপযোগি করে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়, সুবিন্যস্ত শৈলীতে তুলে ধরেছেন নতুন সংস্করণের লেখক। তাফসির-শাস্ত্রের ওপরে লেখকের উচ্চতর পড়াশুনা থাকায় কাজটা তিনি তুলে আনতে পেরেছেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে, আলহামদুলিল্লাহ। সাধারণ পাঠক, কুরআনের গভীরে পৌঁছাতে উৎসুক যেকোনো মানুষের জন্য অনিন্দ্য একটি পছন্দ হবে এটি, ইনশা আল্লাহ।

ইলম-পিয়াসী বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের কাছে সুকুন পাবলিশিং কাজটা ‘মুখতাসার তাফসির আত তাবারি’ নামে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে, ইন শা আল্লাহ। গ্রন্থটির মূল লেখক ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত তাবারি রাহিমাহুল্লাহ এবং নতুন সংস্করণ প্রণেতা ড. আকিল ইবনু সালিম হাফিজাহুল্লাহর জন্যে আমাদের অফুরান দুয়া। মহান রব তাদের পক্ষ থেকে কাজটাকে কবুল করে নিন। সেই সাথে কুরআনের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এই মিছিলে শামিল হওয়ার তাওফিক দিন আমাদেরও। আমাদের কাজগুলো যেন দুনিয়াতে আলোকিত করে মানুষের হৃদয়, আর আখিরাতে আলোকিত করে তুলে আমাদের কবর। আমীন। ওয়ামা তাওফিক্বী ইল্লাবিল্লাহ।