মহররম মাস : তাৎপর্য, ফজিলত ও করণীয়
ইসলামে মহররম মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। ইসলাম পূর্ববর্তী সকল আসমানি ধর্মমতেও বারো মাসের মধ্যে নিষিদ্ধ চারটি মাস যথা জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজবের গুরুত্ব ও ইবাদতসমূহ ছিল বিশেষভাবে পালনীয়। এই মাসগুলোর ইবাদত ও মাহাত্ম্য ছিল অন্যসকল মাসের চেয়ে অধিক ফজিলতপূর্ণ। তেমনিভাবে এই মাসগুলোতে যেকোনো পাপাচার ও অন্যায় কাজকর্মের ভয়াবহতা ও শাস্তিও ছিল অত্যন্ত কঠোর ও নিন্দনীয়।
জাহেলি সমাজেও এই চারটি মাসের অনেক গুরুত্ব ছিল। এ মাসগুলোর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে তারা সকল সীমারেখা মেনে চলত। কিন্তু এই মাসগুলোর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে তারা একটি কুপ্রথার আশ্রয় নিয়েছিল। তা হলো—মাসের সংখ্যা কম বেশি করা কিংবা রদবদল ও আগ-পিছ করা। যুদ্ধে জর্জরিত আরব সমাজের যুদ্ধ যদি কখনও নিষিদ্ধ চারটি মাস পর্যন্ত প্রলম্বিত হতো, তাহলে তারা বলত : এবারের মহররম সামনের সফর মাস থেকে শুরু হবে। এ বছরের মহররম দ্বিতীয় মাস হিসেবে গণ্য হবে। কিংবা সামনের বছরের মহররম থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা কার্যকর হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। — (মাআরিফুল কোরআন, সূরা তাওবা: আয়াত ৩৬)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা মাসের সংখ্যা নির্ধারণ ও মাসের ধারাবাহিকতায় তাদের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও হেরফের নিষিদ্ধ করে বলেন,
إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثۡنَا عَشَرَ شَهۡرٗا فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِ يَوۡمَ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ مِنۡهَآ أَرۡبَعَةٌ حُرُمٞۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُۚ فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ
“প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে (লওহে মাহফুজে) মাসের সংখ্যা বারোটিই সেই দিন থেকে, যেদিন আল্লাহ তায়ালা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি মাস হলো—মর্যাদা পূর্ণ। এটাই সরল দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের প্রতি জুলম-অবিচার করো না।” — (সূরা তাওবা : ৩৬)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মাসের সংখ্যা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করেছেন। তন্মধ্যে চারটি মর্যাদাশীল মাসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে; সেগুলোর সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখার এবং এ সেসব মাসে জুলুম-পাপাচার থেকে বিরত থাকার আদেশ করেছেন।
এই চারটি মাসের মধ্যে মহররমের মর্যাদা অত্যধিক। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মাসকে আল্লাহর মাস বলে উল্লেখ করেছেন। এই মাসের নফল সিয়ামের প্রতি জোর দিয়েছেন, সাহাবিদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। বর্ণনা করেছেন তার সুবিশাল ফজিলতের কথা। নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রমজানের পর শ্রেষ্ঠ সিয়াম হলো—আল্লাহর মাস মহররমের সিয়াম, আর ফরজ সালাতের পর শ্রেষ্ঠ সালাত হলো—কিয়ামুল লাইল। — (মুসলিম শরিফ : ৮৩৪০)
মহররম মাসে সিয়ামের ফজিলত ব্যতীত আশুরা বা দশ তারিখের ব্যাপারে অন্য যত ফজিলত সম্বলিত হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোকে ইমাম ইবনু তাইমিয় রাহিমাহুল্লাহ ভিত্তিহীন বলেছেন।— (মিনহাজুস সুন্নাহ আননাবাবিয়্যা, ৭/৩৯)
মহররম একটি ঐতিহাসিক মাস। এ মাসেই আল্লাহ তায়ালা নবি মুসা ও তার সাথের মুমিনদেরকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ফেরাউনকে দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। ফলে, নবি মুসা আলাইহিস সালাম শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেছিলেন। তাই নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আসার পর তাঁর অনুকরণে সিয়াম পালন করেছেন এবং সাহাবিদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আশুরার সিয়ামের সুবিশাল ফজিলত বর্ণনায় বলেছেন, “আশুরার সিয়াম বিগত এক বছরের (সগিরা) গুনাহের কাফফারা হবে।”— (সহিহ মুসলিম, ১১৬২)
তবে ইয়াহুদিদের সাদৃশ্য ধারণের বিরোধিতা করতে নবিজি আশুরার সিয়াম পালনের জন্য নয় ও দশ তারিখ, অথবা দশ ও এগার তারিখ মিলিয়ে দুটো সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু বর্তমানে আশুরাকে কেন্দ্র করে নানারকম কুসংস্কার যেমন তাজিয়া মিছিল, মাতমবাজি ও শোকপ্রকাশ ইত্যাদির সাথে ইসলামি শরিয়াতের বিধি-বিধান ও নবি মুসার বিজয়ের সাথে পূর্বাপর কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো অত্যন্ত গর্হিত কাজ। হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত নিঃসন্দেহে মুসলিম উম্মাহর জন্য বেদনাদায়ক ঘটনা। সেজন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে সবর ও সওয়াবের প্রত্যাশী হওয়া উচিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার চিরন্তন ফয়সালাকে মেনে নেওয়া আবশ্যক। কিন্তু তাঁর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে তাজিয়া মিছিল করা, সওয়াবের প্রত্যাশা করা—নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তি।
ইবনু রজব হাম্বলি রাহিমাহুল্লাহু বলেছেন, আশুরাকে হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহুর মৃত্যুর কারণে রাফেজি-শিয়াদের মতো মাতম দিবসে পরিণত করা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্টতা। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যখন নবি-রাসুলদের বিপদাপদ ও মৃত্যুর দিনগুলোকেই শোক পালনের অনুমতি দেননি; তাহলে তাঁদের চেয়ে কম মর্যাদার অধিকারীদের ব্যাপারে কীভাবে শরিয়তের অনুমতি থাকতে পারে?!— (লাতায়িফুল মাআরিফ, ১১৩)
হুসাইন রাদিআল্লাহুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ তাঁর বাবা আলি, উমর ও উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের শাহাদত দিবসকে তো তারা এমন করে স্মরণ করে না! তাঁদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রাসুলুল্লাহর মৃত্যুদিবসে এমনটি করার অনুমতি ইসলাম দেয়নি। এটা শুধুই তাদের বিভ্রান্তি ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত রীতিনীতি। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে হেফাজত করুন। এ মাসকে ইবাদতময় করার তাওফিক দান করুন । সকল প্রকার নাফরমানি থেকে বিরত থেকে এ মাসের সম্মান, মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বজায় রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লিখেছেন—
কামরুল ইসলাম
শিক্ষক, জামিয়াতুল মানহাল আলকওমিয়া, উত্তরা, ঢাকা।